সিনথিয়া ভালো নেই

 

অধ্যায় ১: প্রথম দেখা

আকাশটা সেদিন ঠিক যেন সিনথিয়ার মনের মতো—একটু রূপালি, একটু নীল, আর অনেকটা একা।
বিকেল নামতে শুরু করেছে। ধুলোবালি ভেজা হাওয়া এসে শহরের ক্লান্তিকে একটু শান্তি দিচ্ছে।
রাস্তার মোড়ে একটা পুরনো বাসস্ট্যান্ড, তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সিনথিয়া—ছাতা ছাড়াই, ভেজা চুলে।
কেউ তাকিয়ে থাকলে ভাবত, মেয়েটা হয়তো ভুলে গেছে ছাতা আনতে।
কিন্তু সে ইচ্ছে করেই ভিজছিল।

তার কাঁধে একটা স্লিং ব্যাগ, চোখে অদ্ভুত এক শান্ত বিষণ্ণতা।

হঠাৎ একটা গাড়ির শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটি এল—
ভেজা চুল, কাঁধে একটা পুরনো ক্যামেরা, আর হাতে একখানা ছাতা।
সেই প্রথমবার কাব্যকে দেখে সিনথিয়ার মনে হয়েছিল—এই ছেলেটার ভেতরেও হয়তো বৃষ্টি জমে আছে, অনেকদিন ধরে।

— “তোমার ছাতা নেই?”
কাব্য জিজ্ঞেস করেছিল খুব স্বাভাবিকভাবে, যেন চিনত অনেককাল।

সিনথিয়া হেসে বলেছিল,
— “ছাতা থাকলে এই বৃষ্টির ঘ্রাণ পেতাম না।”

কাব্য কিছু বলেনি।
শুধু ছাতাটা এগিয়ে দিয়েছিল তার দিকে।
সিনথিয়া নিয়েছিল না।

সে বলেছিল,
— “আমার ভিজে থাকাটাই দরকার ছিল আজ।”

সেদিন তারা একসাথে খুব কম কথা বলেছিল, কিন্তু সেই কম কথার ভেতরেই গেঁথে গিয়েছিল অনেক কিছু।
বাস এলো, কাব্য উঠলো না।
সিনথিয়া উঠেছিল, কিন্তু যাওয়ার আগে কাব্যের চোখে এক ঝলক তাকিয়ে বলেছিল—
— “তুমি কি কবিতা লেখো?”
— “না। আমি শুধু জীবনটা নিয়ে ভাবি। সেটাও একটা কবিতা হতে পারে।”

বাস ছেড়ে দেয়। কাব্য দাঁড়িয়ে থাকে।
সিনথিয়ার চোখে জল জমে ওঠে—কে জানে বৃষ্টির জন্য, না কি সেই ছেলেটার চোখে লুকিয়ে থাকা অসমাপ্ত কথার জন্য।


অধ্যায় ২: তুমি আমি আর নীরবতা

সেই দিনের পর থেকে শহরের আনাচে-কানাচে যেন কাব্য হঠাৎই বেশি দেখা দিতে লাগল।

কখনও সিনথিয়া দেখত—কাব্য দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে, হাতে সেই ক্যামেরাটা, চোখে সেই একই ক্লান্ত গভীরতা।
আবার কখনও সে বসে থাকে বুকাননের চায়ের দোকানে—এক কাপ আদা চা আর পাশে খোলা একটা ডায়েরি।

তারা প্রায়ই মুখোমুখি হতো, কাকতালীয়ভাবে।
কিন্তু প্রতিবারই, কথার চেয়ে বেশি জায়গা নিত নীরবতা

একদিন সন্ধ্যাবেলা, সিনথিয়া চুপচাপ চলে এল কাব্যের পাশে বসে।
সে কিছু বলল না। কাব্যও না।

দু’জনেই তাকিয়ে ছিল সামনের ভাঙা পুকুরটার দিকে—
যেখানে বৃষ্টির জল জমে এক রকম আয়নার মতো হয়ে আছে, আর তাতে দেখা যাচ্ছে দুটো ছায়া—
একটা একটু কুয়াশা ধরা, অন্যটা কিছুটা ভাঙা।

হঠাৎ কাব্য বলল,
— “তুমি একা হাঁটতে ভালোবাসো কেন?”
সিনথিয়া একটু হেসে বলল,
— “কারও সঙ্গে হাঁটলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় হয়।”

কাব্য মাথা নেড়ে বলল না কিছু।
তবে তার চোখে যেন একটা চুপচাপ স্বীকারোক্তি ছিল—
যেন সেও হারিয়ে যেতে চায়, কিন্তু ঠিক কোনটায়, তা জানে না।

পরদিন কাব্য সিনথিয়াকে একটা পুরনো বই দিল—
রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতা”
ভেতরে একটা লাইন আন্ডার করা ছিল:

"কিছু সম্পর্ক শব্দ চায় না, শুধু উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়—আমি আছি।"

সেই দিন থেকে কাব্য আর সিনথিয়া একসাথে সময় কাটাত, কিন্তু তারা ছিলো একে অপরের নিঃশব্দ সঙ্গী।
কথা বলত কম, চোখে চোখ রাখত বেশি।

তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল একরকম "নামহীন প্রেম"—
যার ব্যাখ্যা নেই, দাবিও নেই।
শুধু দুটো মানুষ, ভাঙা মনের দুটো কিনারা একে অপরের পাশে রেখে হাঁটছিল।

তবে নীরবতার মাঝেও, সিনথিয়া মাঝেমধ্যে অনুভব করত—
কাব্যের ভেতরে একটা অন্ধকার খিঁচিয়ে ধরে আছে তাকে।
যা হয়তো একদিন কেবল নীরবতাই নয়, সম্পর্কটাকেও গিলে ফেলবে।


অধ্যায় ৩: সেই চিঠি

শহরের আকাশ সেদিন অস্বাভাবিক পরিষ্কার ছিল।
সিনথিয়া খুব সকালে ঘুম ভেঙে দেখল, তার ফোনে কোনো মেসেজ নেই, কোনো মিসড কল নেই—
যা প্রতিদিন কাব্য রাখত ঠিকঠাক।

প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি, তারপর অদ্ভুত এক টান।

সে গেল বুকাননের সেই পুরনো চায়ের দোকানে—
কাব্য নেই।

ছুটে গেল সেই পুকুর পাড়ে—যেখানে তারা একসাথে বসে নীরবতা ভাগ করত—
সেখানে শুধু শুকনো পাতার স্তূপ।

শেষবার সে গিয়েছিল সেই পুরনো বাসস্ট্যান্ডে—
যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল।
সেখানে, একটা পুরনো ব্রাউন খামে মোড়া চিঠি পড়ে ছিল তার নামের ওপর লেখা—

"সিনথিয়া"

তার হাত কাঁপছিল চিঠিটা খুলতে।
চোখে পানি জমে উঠেছিল আগেই, যদিও তখনও জানত না কাব্য কী লিখেছে।

চিঠিতে ছিল:


“সিনথিয়া,
তুমি কখনও বুঝতে দেবে না, তবু জানো—তুমি আমার সবচেয়ে সুন্দর অভ্যাস ছিলে।
তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমি ভুলে গেছিলাম, আমার ভেতরে কতটা অন্ধকার জমে আছে।

কিন্তু সেই অন্ধকারটা শুধু আমাকে ঘিরে নেই, সেটা তোমাকেও ছুঁয়ে ফেলবে—এই ভয়টাই আমি ভুলতে পারি না।
তুমি আলো। তুমি মুক্ত। আর আমি?

আমি সেই মানুষ, যে কবিতা ভালোবাসে, কিন্তু কোনো দিন তা শেষ করতে পারে না।

তোমার ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমাকে দুঃখ দিতে চাই না।
তাই চলে যাচ্ছি।
শুধু এটুকু মনে রেখো—তুমি ভালোবাসতে পেরেছ, এটাই তোমার সবচেয়ে বড় জাদু।

বিদায়,
– কাব্য


সিনথিয়া অনেকক্ষণ বসে ছিল।
চিঠির নিচে তার একটা চোখের পানি পড়ে ছাপ রেখে গিয়েছিল।
চারপাশে তখন নিঃশব্দে বৃষ্টি পড়ছিল।

কেউ না দেখে থাকলেও, সে জানে—তার বুকের ভেতর একটা কিছু চিরদিনের জন্য ভেঙে গেছে।

সেইদিনের পর থেকে কেউ আর শুনেনি সিনথিয়ার হাসির শব্দ, বা দেখেনি তার চোখের দীপ্তি।

শুধু একটা কথা ধীরে ধীরে শহরে ছড়িয়ে পড়ে—
“সিনথিয়া ভালো নেই।”



অধ্যায় ৪: শহর ছাড়া এক সকাল

রাতে ঘুম হয়নি একটুও।
সিনথিয়া জানালার পাশে বসে কাব্যের চিঠিটা হাতে নিয়ে বারবার পড়েছে—যেন কোথাও একটা লুকানো সংকেত আছে, যেটা সে বুঝতে পারছে না।

বাইরে ভোরের আলো নামছে ধীরে ধীরে। শহরের পাখিরা ডাকে, গাড়ির শব্দ নেই, মানুষও তেমন হাঁটছে না—একটা নতুন দিনের নিঃশব্দ জন্ম।

সিনথিয়া ব্যাগ গোছায়।
কিছু কাপড়, কিছু বই, কাব্য উপহার দেওয়া “শেষের কবিতা”, আর সেই চিঠি—
এগুলোই তার সম্বল।

কোথায় যাবে জানে না।
তবে কাব্য চলে যাওয়ার পর এই শহরের প্রতিটা রাস্তা, দোকান, আলো যেন তার বুকের ওপরে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

সে একটা টিকিট কাটে উত্তরবঙ্গের এক ছোট্ট শহরের জন্য—যেখানে নাকি কাব্যের এক পুরনো পরিচিত ছিল, একজন চিত্রশিল্পী।
একবার কাব্য বলেছিল,
— “ওখানে গেলে রাতের আকাশটা হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়।”

ট্রেনে বসে সিনথিয়া জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে।
সে কাঁদছে না, হাসছেও না—
তার মুখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, চোখে ঘুম না-পাওয়ার লাল ছায়া।

তার পাশে বসা এক বুড়ো ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি একা যাচ্ছো?”
সে মাথা নাড়ে।
— “হ্যাঁ, কিন্তু একা আমি অনেক দিন ধরেই।”

ট্রেন চলতে থাকে, শহর পেছনে পড়ে যায়।

সিনথিয়া জানে না কাব্যকে সে খুঁজে পাবে কিনা, অথবা আদৌ সে আছে কিনা।
তবে এতদিন পর প্রথমবার তার মনে হলো—
এই যাত্রাটা শুধু কাব্যের জন্য নয়, বরং নিজের সেই অংশটাকে ফিরে পাওয়ার জন্য, যেটা একদিন কারো চিঠির ভেতর ভেঙে পড়েছিল।


অধ্যায় ৫: সিনথিয়া ভালো নেই

ছয় মাস কেটে গেছে।
সিনথিয়া এখন থাকে পাহাড়ের পাদদেশে এক নির্জন ছোট্ট কটেজে।
চারপাশে চা বাগান, পাখির ডাক, আর গভীর নিস্তব্ধতা—যেটা কাব্য বর্ণনা করেছিল কোনো এক বিকেলে।

কাব্যকে সে এখনও খুঁজে পায়নি।
যে চিত্রশিল্পীর কথা কাব্য বলেছিল, তিনি বললেন—“ও এখানে এসেছিল একবার, তারপর হারিয়ে যায় আরও উত্তরের দিকে, নেপালের দিকে বোধহয়।”

সিনথিয়া খুঁজতে গিয়েছিল, কিন্তু কোথাও কোনো নাম, কোনো ছায়াও নেই।
কাব্য যেন মাটি ছুঁয়ে হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেছে।

তবুও সিনথিয়া প্রতিদিন একটা ডায়েরিতে লিখে—
কাব্যকে উদ্দেশ করে নয়, বরং সেই মেয়েটাকে উদ্দেশ করে, যে একদিন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল ছাতা ছাড়া।
সে লেখে—

"আমি আজও তোমার নাম নিই না কাব্য,
কারণ নামগুলো বেশি দিন থাকেনা।
তবে তোমার চোখের রঙটা এখনও আঁকি কুয়াশার ভেতর।
তুমি গেলে—আর কেউ আসেনি। আমি চেয়েও চাইনি।"

গ্রামের লোকেরা বলে—এই মেয়েটা চুপচাপ থাকে, কথা বলে খুব কম,
কিন্তু তার ঘরের বাতাসে কেমন একটা বিষণ্ণ সুর বাজে।

একদিন এক বাচ্চা মেয়ে সিনথিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল—
— “আপু, তুমি কি ভালো নেই?”
সিনথিয়া তখন শুধু হেসেছিল—
একটা ভাঙা হাসি, যা চুপিচুপি বলে গিয়েছিল সেই ছোট্ট বাক্যটা:

“আমি ভালো নেই। অনেকদিন ধরেই।”

কোনো এক অন্ধকার রাতে, বৃষ্টির শব্দে ভেজা কাগজে সিনথিয়া শেষবারের মতো একটা চিঠি লিখেছিল কাব্যকে—


**"প্রিয় কাব্য,
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি হারিয়ে গেছি নিজের মধ্যেই।
তুমি বলেছিলে, তুমি অন্ধকার।
আমি বলিনি—আমি অন্ধকারকে ভালোবাসতাম।
তুমি না থাকলেও, আমি আজও তোমার অপেক্ষায় রইলাম।

শুধু জানিও,
সিনথিয়া ভালো নেই।
আর হয়তো কখনো হবেও না।
”**


সমাপ্ত।


Comments

Popular posts from this blog

তুমির অভাবে

হতে চাই জামাই